কোনো সন্ত্রাসী হামলায় মুসলমান জড়িত থাকলে পুরো মুসিলম সম্প্রদায়কে দায়ী করা হলেও একজন শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থীর হামলার বেলায় তা হয় না। এমনটাই বললেন আলোচিত মার্কিন নারী কংগ্রেস সদস্য ইলহান ওমর। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্ণবাদী মন্তব্যের শিকার এ নারী আলজাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন।
কী বলেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প
একসাথে করা তিনটি টুইটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কংগ্রেসের তিন নারীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ‘ভয়ঙ্করভাবে’ সমালোচনা করার অভিযোগ তুলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘খুবই অবাক লাগে দেখতে যখন ‘প্রগতিশীল’ ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসের নারী সদস্যরা, যারা এমন দেশ থেকে এসেছেন যেখানে তাদের সরকার বিপর্যস্ত, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং সবচেয়ে অদক্ষ, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রে এসে এখানকার মানুষদের বলছে কিভাবে আমাদের সরকার পরিচালনা করতে হবে।’
‘তারা কেন তাদের নিজেদের অপরাধপ্রবণ দেশে ফিরে গিয়ে পরিস্থিতির উন্নয়ন করে না! তারপর ফিরে এসে আমাদের জানালেই পারে যে কিভাবে সে কাজ করল তারা।’
এরপর ট্রাম্প স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির উল্লেখ করেন, যার ফলে কংগ্রেসের কোন কোন নারী সদস্যকে নিয়ে মন্তব্য করেছেন তাদের নাম উল্লেখ না করলেও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে কাদের বিষয়ে এসব মন্তব্য করেছেন তিনি।
কাদের উদ্দেশ করে এই মন্তব্য
যাদের উদ্দেশে ট্রাম্পের এই টুইট, তাদের মধ্যে আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ, রশিদা তালিব এবং আয়না প্রেসলির জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা আমেরিকাতেই। অন্য কংগ্রেস ওম্যান ইলহান ওমর ১২ বছর বয়সে শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। ট্রাম্পের এই মন্তব্যের আগের সপ্তাহব্যাপী ন্যান্সি পেলোসির সাথে ওকাসিও-কর্টেজের কিছুটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। ওকাসিও-কর্টেজ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন যে, সীমান্ত নিরাপত্তা বিল নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের সাথে দ্বন্দ্বের সময় ভিন্ন বর্ণের নারী কংগ্রেস সদস্যদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছেন তিনি। এই চার কংগ্রেস ওম্যান ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরে সোচ্চার। সেই রাগেই ট্রাম্পের তিনটি টুইট।
কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে
মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন মন্তব্যের নেতিবাচক সমালোচনাই বেশি হয়েছে। স্পিকার পেলোসি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টুইট সম্পর্কে লিখেছেন যে মন্তব্যটি ‘জেনোফোবিক’ (বিদেশীদের সম্পর্কে অহেতুক আতঙ্ক তৈরি করার প্রবণতা)। নিজের টুইটে পেলোসি লেখেন, ‘আমাদের বৈচিত্র্যই আমাদের শক্তি এবং একতাই আমাদের ক্ষমতা।’
ট্রাম্পের এই মন্তব্যে ডেমোক্র্যাটরা তো বটেই, রিপাবলিকান রাজনীতিবিদদেরও অনেককেই সমালোচনা করেছেন। সাবেক রিপাবলিকান শীর্ষ নেতা জন ম্যাককেইনের মেয়ে মেগ্যান ম্যাককেইন, যিনি নিজেও রিপাবলিকান সমর্থক কলামিস্ট, বলেছেন, ‘এই মন্তব্য বর্ণবাদী।’ তিনি বলেন, ‘এই দেশে আমরা যাদের একবার স্বাগত জানিয়েছি, তাদের আবার ফিরে যেতে বলি না।’
সামাজিক মাধ্যমে ট্রাম্পের এই মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছে অধিকাংশ মানুষ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে কড়া ভাষায় জানিয়েছেন, ট্রাম্পের এই মন্তব্য কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। ট্রাম্পের বর্ণবাদী মন্তব্য থেকে নিজেকে দূরে রাখার কথা জানিয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর আঞ্জেলা মার্কেল। তার মতে, ট্রাম্পের ওই মন্তব্য আমেরিকার মূল্যবোধের পরিপন্থী। একই সাথে তিনি যে নারীদের কটাক্ষ করে ট্রাম্প মন্তব্য করেছেন, তাদের প্রতি সংহতি জানান মার্কেল। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অবদান এবং ত্যাগের মধ্য দিয়েই আমেরিকা তার শক্তি অর্জন করেছে বলেও জানান জার্মান চ্যান্সেলর। কিন্তু দেশটির প্রেসিডেন্টের বক্তব্য দেশটির শক্তিমত্তারও পরিপন্থী।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবিদ্বেষ শতবর্ষ পুরনো
উনিশ শতকের শেষার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী ও কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর প্রতি শ্বেতাঙ্গ জনগণের চরম বর্ণবাদী আচরণ থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল ১৮৬৩ সালের মার্কিন গৃহযুদ্ধ। আব্রাহাম লিঙ্কন ছিলেন সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ষোড়শ প্রেসিডেন্ট। মার্কিন মুল্লুক থেকে বর্ণবাদ ও দাসপ্রথার স্থায়ী বিলুপ্তি এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনগণের প্রতি আহ্বান জানাতে ১৮৬৩ সালের ঐতিহাসিক গেটিজবার্গ বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি।
মার্কিন গৃহযুদ্ধের ঠিক ১০০ বছর পর ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আবারো প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত রাজ্যগুলোয় শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদী আচরণ আবারো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারই প্রেক্ষাপটে কৃষ্ণাঙ্গ মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে’ (আই হ্যাভ এ ড্রিম) নামে বহুল পরিচিত ভাষণ দেন, যা ছিল গেটিজবার্গ বক্তৃতারই পুনরাবৃত্তি। কিন্তু তার বক্তব্যও শ্বেতাঙ্গরা পছন্দ করেনি। ফলে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এ নেতাকে ১৯৬৮ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারাতে হয়।
এরই মধ্যে আরো ৫৪ বছর পেরিয়ে গেছে। লিঙ্কন বা লুথারের সেই স্বপ্ন বলতে গেলে অধরাই রয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। আজো দেশটির কৃষ্ণাঙ্গ জনগণ ক্ষণে ক্ষণে শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা নানাভাবে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হচ্ছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলে খানিকটা থিতিয়ে থাকলেও ২০১৭ সালে দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর বর্ণবাদ, জাত বিদ্বেষের মাত্রা বেড়ে গেছে। বাড়বে না কেন? প্রেসিডেন্ট নিজেই তো বর্ণবাদী! কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্বেষী!! ক্ষমতায় আসার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের ঢোল পেটাচ্ছেন ট্রাম্প।
২০১৭ সালে ভার্জিনিয়ার শ্যার্লটভিলে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভে শ্বেতাঙ্গদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন তিনি। এক বছর পরে ওয়াশিংটনে অভিবাসন নিয়ে এক বৈঠকে আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোকে ‘শিটহোল’ (অত্যন্ত নোংরা জায়গা) বলে মন্তব্য করেন ট্রাম্প। আফ্রিকান ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলো এ মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। এমন বিতর্কিত মন্তব্য করে আবারো যুক্তরাষ্ট্রে শতবর্ষের বর্ণবাদযুদ্ধের সূচ ফুটালেন ট্রাম্প।
ক্ষমতা গ্রহণের শুরু থেকেই অভিবাসী কমাতে মুসলিম দেশগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তিনি। তার এ প্রকল্প একদিকে যৌক্তিক হলেও শত বছর আগের অভিবাসী আইনের বিপরীত। ব্যবসায় মন্দা, পূর্ব ইউরোপে দুর্ভিক্ষ এবং বিভিন্ন দমন-নিপীড়নের কারণে ১৮৪০ এর দশক থেকে ১৮৯০ এর দশক পর্যন্ত জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ব্রিটেন এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে প্রায় দেড় কোটি মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিল।
১৯২৪ সালে কংগ্রেস জাতীয়তার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপে সমন্বিত একটি পদক্ষেপ নেয়, যার আওতায় দেশটিতে পশ্চিম ইউরোপিয়ানদের প্রবেশ সহজ করা হয়। এরপর ১৯৬৫ সালে কংগ্রেস অভিবাসন আইন পাস করে, যা এশিয়া, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবীয় অঞ্চল এবং মেক্সিকো থেকে লাখ লাখ মানুষকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার নতুন অভিবাসীদের জন্য বিধিবিধান আরোপ করে বেশ কিছু বিল পাস করেছে। ১৯৮৬ সালে কংগ্রেসে পাস হওয়া এক আইনের আওতায় ১৯৮২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অবৈধ অভিবাসীরা বৈধতা লাভের জন্য আবেদন করার সুযোগ পায়।
কিন্তু এসব আইনকে উপেক্ষা করে নিজের গোঁড়ামিতে মনোযোগী ট্রাম্প। মুসলিম দেশগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কিছুটা সফল হয়েছেন তিনি। আফ্রিকার দেশগুলোকে শিটহোল বলে মন্তব্য করে ট্রাম্প কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর কোপ শুরু করেন বলে মনে করেছেন বিশ্লেষকেরা।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিবাসন ঐতিহাসিক মায়ে নাগাই বলেন, ‘মিস্টার ট্রাম্পের এ ধরনের মন্তব্য পূর্বাঞ্চলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউরোপিয়ান ও এশিয়ান দেশগুলোর বিরুদ্ধে করা বিংশ শতাব্দীর বর্ণবাদী ভাষাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।